সেদিন মুহূর্তেই নেভানো হয় আলো, শাপলা হয়ে ওঠে রক্তাক্ত ময়দান

পাঁচ মে। ভয়ংকর এক রাত। এদিন রাতেই বাংলাদেশে ঘটেছিল নারকীয় হত্যাকাণ্ড। ঝরেছিল আলেম-ওলামাসহ নিরীহ মানুষের তাজা রক্ত। বলছি ২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের গণসমাবেশে নৃশংসতার কথা। সেদিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল গোটা এলাকা।
হেফাজতে ইসলামের গণসমাবেশ ঘিরে শাপলা চত্বরে ভোর থেকেই জড়ো হতে থাকেন লাখো জনতা। দিনভর সমাবেশে থাকায় ক্লান্ত শরীরে গভীর রাতে ঘুমাচ্ছিলেন অনেকে। কেউ কেউ জিকিরে মশগুল। ঠিক তখনই নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এ আঁধার প্রাকৃতিক নয়। বিদ্যুৎ বন্ধ করে আলো নিভিয়ে দেয় পুলিশ-র্যাব, বিজিবি। এরপরই গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ হেফাজত নেতাকর্মী ও তওহিদী জনতাদের ওপর। মুহূর্তেই তাদের রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন হাজারও মানুষ। গুলি আর সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে পুরো এলাকা থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। জনশূন্য হয়ে পড়ে মতিঝিল।
২০১৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি পেশ করে হেফাজতে ইসলাম। এ দাবি বাস্তবায়নে ঢাকায় বড় সমাবেশ করে সরকারকে এক মাসের আলটিমেটাম দেয় সংগঠনটি। দাবি মানলে ৫ মে ঢাকা অবরোধ ও শাপলা চত্বরে বৃহত্তর জমায়েতের কর্মসূচি দেওয়া হয়।
আর এ কর্মসূচির ডাক পেয়ে সেদিন ভোর ৫টায় ফজরের নামাজের পরই রাজধানীর প্রবেশমুখে জড়ো হতে থাকেন কওমি ঘরানার আলেম-ওলামাসহ লাখো জনতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা উপেক্ষায় তারা আসেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে জনতার স্রোত। ঢাকার ভেতরে প্রবেশ করে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতারা। কিন্তু অনুমতি দিচ্ছিল না পুলিশ। এ নিয়ে দফায় দফায় চলে আলোচনা। এরই মধ্যে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নগরীতে কয়েকটি মিছিল ঢুকে পড়ে। শেষ পর্যন্ত শাপলা চত্বরে এসে শুধু মোনাজাত করেই কর্মসূচি শেষ করার শর্তে অনুমতি দেয় ডিএমপি। দুপুর দেড়টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে ঢাকার সব প্রবেশমুখ থেকে তওহিদী জনতা মিছিল নিয়ে শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন।
শাপলা চত্বরে মিছিল আসার পথে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও পল্টন এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাধার মুখে পড়েন তারা। একপর্যায়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ দফায় দফায় গুলি ও টিয়ারশেল ছোড়ে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকা থেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা বায়তুল মোকাররমে বইয়ের দোকানে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে পবিত্র কোরআন শরিফসহ বিভিন্ন ইসলামি বই পুড়ে যায়।
সন্ধ্যা নাগাদ সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন নিহত হন। সন্ধ্যায় শাপলা চত্বরে হেফাজত নেতাদের বক্তব্যে দাবি না মানা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করার ঘোষণা আসতে থাকে। রাত ৮টার দিকে এক বিবৃতিতে নেতাকর্মীদের হেফাজতকে সহযোগিতার আহ্বান জানান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এর আগে সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিকেল ৪টার মধ্যে শাপলা চত্বর ছাড়ার হুমকি দেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। এ সময়ের মধ্যে ঢাকা না ছাড়লে পরিণতি ভালো হবে না বলেও জানান তিনি।
একই সঙ্গে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে সরকারের দফায় দফায় বৈঠক চলে। এরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রণসাজে সজ্জিত হয়। লালবাগ মাদরাসায় ছিলেন হেফাজত আমির আল্লামা শফীসহ অন্য নেতারা। সেখানে তাদের অবরুদ্ধ করে আল্লামা শফীকে শাপলা চত্বরের সমাবেশ বন্ধের জন্য চাপ দিতে থাকে পুলিশ। একপর্যায়ে রাত ১০টায় তাকে নিয়ে সমাবেশের উদ্দেশে রওনা হলেও পথে এসে বলে দেওয়া হয় তিনি অসুস্থ। এরপর তাকে টিকিট করে বিমানে তুলে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেন ডিবিপ্রধান হারুন।
সেদিন শেখ হাসিনার পতন অনিবার্য বুঝতে পেরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে হেফাজতের সমাবেশ ভণ্ডুল করার ভয়ংকর নৃশংস পরিকল্পনা নেয় সরকার। রাত ১টার পর থেকেই শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’, র্যাবের ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট শাপলা’ ও বিজিবির ‘অপারেশন ক্যাপচার শাপলা’ নাম দিয়ে অভিযান চালানো হয়। রাত পৌনে ৩টায় শুরু হয় মূল অভিযান। এর আগে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুরো মতিঝিল ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়। অভিযান চলে একযোগে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ।
এ নিয়ে তথ্যানুসন্ধান চালায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। তাদের প্রতিবেদনে ৬১ জন নিহতের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হয়। যদিও হেফাজতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল শাপলা গণহত্যায় আড়াই হাজার নিহত ও ১০ হাজারের বেশি আহত হওয়ার কথা বলা হয়। শাপলার গণহত্যা সরাসরি সম্প্রচারের অভিযোগে দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামী টেলিভিশন ‘সাময়িক’ বন্ধ করে দেয় হাসিনার সরকার।