মেজর জিয়া || দ্যা ফুল স্টেটসম্যান

ইতিহাস জুড়ে দেখা যায়, অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রের সাহসী ও শক্তিশালী সেনা কর্মকর্তারা দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এই ধরনের নেতারা সাধারণত শৃঙ্খলা ও নেতৃত্বের গুণে সমৃদ্ধ, কিন্তু তাদের শাসনব্যবস্থা ছিল বহুমাত্রিক—কেউ গণতান্ত্রিক রীতি প্রতিষ্ঠা করেছেন, আবার কেউ একনায়কতান্ত্রিক শাসন দিয়েছেন। এই প্রবন্ধে আমরা এমন পাচজন প্রভাবশালী সেনা জেনারেলের জীবন ও শাসনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করব।
প্রথমেই জর্জ ওয়াশিংটন। মার্কিন স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কন্টিনেন্টাল আর্মির সর্বাধিনায়ক ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। যুদ্ধজয়ী এই নেতা পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন। ওয়াশিংটনের নেতৃত্ব ছিল সংযমী, নীতিনিষ্ঠ এবং গণতান্ত্রিক। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষগ্রহণ করেননি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ক্ষমতা স্বেচ্ছায় হস্তান্তরের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা যা মার্কিন গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়ে দেয়। তার সময়ের মধ্যে প্রথম জাতীয় মুদ্রানীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থা স্থাপিত হয় এবং তিনি জাতীয় ঐক্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্র বাহিনীর ইউরোপীয় কমান্ডার এবং ডি-ডে অভিযানের প্রধান নেতা ছিলেন ডুইট আইজেনহাওয়ার। যুদ্ধশেষে তিনি ৩৪তম মার্কিন রাষ্ট্রপতি হন। আইজেনহাওয়ার ছিলেন কৌশলী ও মধ্যপন্থী নেতা, যিনি স্নায়ুযুদ্ধের শুরুর সময় যুক্তরাষ্ট্রকে স্থিতিশীলভাবে পরিচালনা করেন। তার শাসনামলে ইন্টারস্টেট হাইওয়ে সিস্টেম চালু হয় যা দেশের অবকাঠামো বিপ্লব ঘটায়। বিদায়ী ভাষণে তিনি ‘মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’ সম্পর্কে সতর্কবার্তা দেন। এছাড়া বর্ণবৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে তার অবদান স্মরণীয়।
শার্ল দ্য গল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রি ফ্রেঞ্চ ফোর্সের নেতা হিসেবে ফ্রান্সের মুক্তির প্রতীক ছিলেন শার্ল দ্য গল। পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্সের পঞ্চম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে প্রথম রাষ্ট্রপতি হন। দ্য গলের শাসনক্ষমতা ছিল শক্তিশালী, জাতীয়তাবাদী ও দূরদর্শী। তিনি ফ্রান্সের উপনিবেশিক যুদ্ধ বিশেষ করে আলজেরিয়া যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে দেশকে বিশ্বমঞ্চে পুনরুজ্জীবিত করেন। তার শাসনকালে ছাত্র আন্দোলন ও গণবিক্ষোভের প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়।
আন্তোনিও লোপেজ দে সান্তা আন্না। মেক্সিকোর ইতিহাসে বিতর্কিত এক নেতা, সান্তা আন্না ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং একাধিকবার (১১ বার) রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও স্বৈরশাসক ছিলেন। ১৮৩৩ থেকে ১৮৫৫ সালের মধ্যে তার শাসন অবিচ্ছিন্ন না হলেও, তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও অস্থির নেতৃত্ব মেক্সিকোর জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়। টেক্সাস বিপ্লব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ব্যাপক ভূখণ্ড হারানোর ঘটনাগুলো তার নেতিবাচক দিক হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত। তবে মেক্সিকোর স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান এবং জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার ইতিহাসও গুরুত্বপূর্ণ।
মেজর জিয়াউর রহমান
মেজর জিয়াউর রহমানকে নিয়ে অধ্যয়ন করতে হিলে প্রথমেই যে বিষয়টি আসে তা হচ্ছে তার দেশপ্রেম। দেশপ্রেম একটি গভীর অনুভূতি, যা ব্যক্তির চিন্তাধারা, আচরণ এবং কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে জিয়াউর রহমান এমন একজন ব্যতিক্রমী নেতা, যিনি একাধারে স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাষ্ট্রনায়ক এবং প্রয়োজনে সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তার দেশপ্রেম নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের তাত্ত্বিকভাবে দেশপ্রেমের ধারণা, তার প্রেক্ষাপট এবং জিয়ার জীবনের সঙ্গে তা কতটুকু সংগতিপূর্ণ, সেই দিকগুলোর দিকে নজর দিতে হয়।
দেশপ্রেমের মৌলিক দর্শন হল, ব্যক্তি তার দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকবে। দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং মানুষের মর্যাদা রক্ষার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও সে পিছপা হবে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে জিয়াউর রহমানের জীবনকে দেখলে, দেশপ্রেমের সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতা অনুভব করা যায়। তিনি ছিলেন একজন পেশাদার সেনা কর্মকর্তা, যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করছিলেন, কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মানুষের উপর নৃশংস আক্রমণ চালালো, তখন মেজর জিয়া আর একজন নিয়মিত সেনা কর্মকর্তা রইলেন না। তিনি এক সাহসী বিদ্রোহী যোদ্ধায় পরিণত হলেন। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক প্রতীকেরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তাত্ত্বিকভাবে, এটি ছিল সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের প্রকাশ—অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, মানুষের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানো এবং নিজের জীবনকে দেশের জন্য উৎসর্গ করার মানসিকতা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জিয়ার নেতৃত্বাধীন জেড ফোর্স বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কৌশল ও বিজয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যুদ্ধের মাঠে থেকে নেতৃত্ব প্রদান করা তার দেশপ্রেমের সাহসী প্রকাশ। যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ, যুদ্ধের নীতি-নিয়ম নির্ধারণ এবং সৈনিকদের অনুপ্রেরণা দেওয়া তার নেতৃত্বগুণ ও দেশপ্রেমের স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণ।
তবে জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম শুধু মুক্তিযুদ্ধে সীমাবদ্ধ ছিল না; রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার কর্মকাণ্ডেও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক সংকটকালে, যখন দেশ রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল, তখন তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, প্রশাসনিক কাঠামো শক্তিশালী করা, বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ—এই সবই তার দেশপ্রেমের বাস্তবমুখী দিককে তুলে ধরে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং শিল্পায়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাত্ত্বিকভাবে, এটি একটি প্রজাতান্ত্রিক এবং উন্নয়নমুখী দেশপ্রেমের প্রকাশ, যেখানে ব্যক্তিগত ক্ষমতার চেয়ে রাষ্ট্রের অগ্রগতি ও জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম ছিল এক গভীর রাজনৈতিক ও নৈতিক দর্শনের বহিঃপ্রকাশ, যেখানে দেশমাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষা, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা একসঙ্গে মিশে গেছে। দেশপ্রেম তার কাছে শুধুমাত্র হৃদয়ের একটি অনুভূতি নয়, বরং একটি রাষ্ট্রনির্মাণের কর্মপ্রক্রিয়ার অংশ, যা তিনি তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বহন করে গিয়েছেন।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কার্যত একটি সংকটময় সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামরিক অভ্যুত্থান এবং নেতৃত্বশূন্যতার এক ভয়ঙ্কর শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এর মধ্য থেকে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ধারাবাহিকতা ফিরিয়ে আনা ছিল তার প্রথম এবং অন্যতম বড় সাফল্য। রাষ্ট্রনেতার প্রথম দায়িত্ব হলো দেশের সংবিধান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যা জিয়া তার শাসনামলে বাস্তবায়ন করেছেন। তার নেতৃত্বে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন পুনর্গঠিত হয়, এবং একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে।
তাত্ত্বিকভাবে, জিয়ার নেতৃত্বকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি একধরনের "প্রাগম্যাটিক লিডারশিপ" বা বাস্তববাদী নেতৃত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। আদর্শবাদ ও আবেগের পরিবর্তে তিনি বাস্তবিক চাহিদার প্রতি মনোযোগী ছিলেন। দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্পায়নের উদ্যোগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন—এসব ক্ষেত্রে তার নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন ক্ষমতা তাকে একজন সফল রাষ্ট্রনেতার আসনে বসিয়েছিল। তার সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক গভীর মন্দার পর ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার দিকে এগোয়, যা রাষ্ট্রপ্রধানের উন্নয়নমুখী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
জিয়াউর রহমানের আরেকটি বড় অবদান ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। শেখ মুজিবুর রাহমানের একদলীয় শাসনব্যবস্থার (বাকশাল) পরিবর্তে বহুদলীয় রাজনীতি ফিরিয়ে আনায় তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি প্রকাশ পায়। তাত্ত্বিকভাবে, গণতন্ত্র একটি রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত, এবং জিয়া সেই গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠন করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি ন্যূনতম সহনশীলতার পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। এটি তাকে তাত্ত্বিকভাবে সফল রাষ্ট্রনেতার সংজ্ঞার কাছাকাছি নিয়ে যায়, যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না রেখে জনগণের অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা ছিল স্পষ্ট।
অন্যদিকে, জিয়ার প্রবর্তিত "বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ" তত্ত্ব একটি রাষ্ট্রিক ঐক্য গঠনের প্রয়াস ছিল। তাত্ত্বিকভাবে, জাতীয়তাবাদ একটি রাষ্ট্রের আত্মপরিচয় নির্মাণের ভিত্তি। শেখ মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ছিল রাষ্ট্রকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের প্রতিফলন, যেখানে ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য এর মধ্যে সমন্বয় করে একটি নতুন জাতীয় পরিচয় তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি জাতীয় ঐক্য রক্ষায় একটি নতুন দর্শন প্রবর্তন করেছিলেন, যা তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্রগঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
শেষের দিকে তূলনামূলক আলাপে একথা দ্বার্থ্যহীনভাবে বলা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া সেনাপতি ফ্রান্সের শার্ল দো গোল, আমেরিকার সর্বকালের সেরা প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন কিংবা অন্যদের সামনে সংবিধিবদ্ধ বাকশাল নামক রেডিমেড কোনো ক্ষমতার থলে ছিলো না। থাকলে পঞ্চম রিপাবলিকের জন্ম হতো কি না কিংবা গণতন্ত্রের সূতিকাগার আমেরিকা আজকের অবস্থানে থাকতো কি না আমরা জানি না । যুদ্ধ বিধ্বস্ত, দারিদ্র্য পীড়িত এবং চরম অস্থিরতা বিরাজমান একটি দেশের সমৃদ্ধ অর্থনীতির স্বপ্নে বিভোর হয়ে কাধে কোদাল তোলে নিতেন কি না জানি না।
যেটা পেরেছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র সফল প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রাহমান।